ইদানীং দেখছি বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে এক অন্যরকম প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতা আসলে ভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে, কে কতো বেশি কওমি হুজুর আনতে পারে এবং কার প্রোগ্রাম কত বেশি গরম হয় তারই এক উন্মত্ত প্রতিযোগিতা চলছে। এসব টিভি প্রোগ্রাম গুলতে বেশিরভাগ সময় উপস্থিত থাকে দুই জন মাওলানা এবং একজন তাগুদি লেখাপড়া করে শিক্ষিত কোন হেফাজতী বুদ্ধিজীবী। এদের কথাবার্তার মুল আলোচ্য বিষয় হলো তাদের মাদ্রাসা শিক্ষা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে কত বেশি উন্নত এবং এ ধরনের মাদ্রাসায় যা শেখায় তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্বের অন্য কোন ইন্সটিটিউট থেকে কত ভালো ইত্যাদি।
এক সময় বাংলাদেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রায় ৯৮ ভাগই ছিলেন আওয়ামীলীগ এর সমর্থনকারী এবং বাকি দুই ভাগ ছিলেন বাম ধারার লোকজন। কিন্তু আওয়ামীলীগের ৯৮ ভাগ বুদ্ধিজীবীই এখন থেমিস লেডির শাড়ি টেনে হিঁচড়ে নামাতে তৎপর। গতকাল এদের একাংশ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা করে থেমিস বিষয়ে সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে এসেছেন। ইনাদের প্রায় সবাই পাঠ্যসূচীকে সাম্প্রদায়িকরণ করার সময় চুপ করেছিলেন।
জামাতী বুদ্ধিজীবী এদেশে কখনই হালে পানি পায়নি। এর কারণটা হচ্ছে জামাত প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী এদেশের হুজুরদের বেশির ভাগের বিরাগভাজন ছিলেন। তার সঙ্গে একাত্তরে তাদের রাজাকার ইমেজ তাদেরকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছিল। সেই অসুবিধা হেফাজতী বুদ্ধিজীবীদের নেই। হেফাজতী বুদ্ধিজীবীরা স্বেচ্ছা শ্রম খাটছেন যার যার ধান্দা বাস্তবায়ন করতে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে আরব দেশের ঘাস খেয়ে শ্বাস নেয় এটা দেখে তারা বুঝে গেছে এদেশে গণতন্ত্র সেক্যুলারিজমের কোন ভাত নেই যেটা তারা ব্যবহার করে খেতে পারেন। তাই জনগণের পাল্স বুঝে তাদের ধর্মান্ধ রেখেই ধান্দা বাস্তবায়ন করতে হবে।
মাদ্রাসা শিক্ষাকে তাদের ভাল বলার অর্থ এটা না স্কুল বাদ দিয়ে মাদ্রাসায় সবাইকে তারা ভর্তি হতে বলছে। মাদ্রাসা থেকে ডারউন-কার্ল মাক্স বের হবার গল্প বলার অর্থ স্কুলগুলো যেন মাদ্রাসা থেকে নিজেকে আধুনিক না ভেবে উল্টো নিজেকে ব্যর্থ ভাবতে শেখে। মাদ্রাসার মত জন্মান্ধ উৎপাদনের কারখানা স্কুলকে করতে হলে প্রথমে এর পাঠ্যসূচীতে কাঁচি চালাতে হবে। অন্যদিকে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীকে আন্তর্জাতিক মানের বলে একটা সার্টিফিকেট দিয়ে রাখতে হবে। জিনিসগুলো সিরিয়ালের মত। এদেশের ছেলেমেয়েরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক যাতে না পড়ে তার জন্য কাশেম বিন আবু বকরকে এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে মনে হয় উনি দুর্বল লেখক হলেও আসলে উপন্যাসের ভাষা আর চিন্তা এরকমই মুসলিম ঘরোনার হতে হবে। কারণ আমরা মুসলমান! আমরা কেন কোলকাতার হিন্দুদের মত করে লিখব?
এসবের পথে বাধা কারা? অবশ্যই সেক্যুলারপন্থিরা। কিন্তু এদেশের সেক্যুলার তো সবচেয়ে সংখ্যালঘু। এদের বেশির ভাগই ভীড়ের মাঝে লুকিয়ে থাকে। তাদেরকে পাত্তা দেয়ার কি আছে। তাছাড়া শহুরে কয়েকজন সেক্যুলারপন্থি ফেইসবুকে কি লিখল না লিখল তা কতজন পড়ে? আর যে ৯৮ জন আওয়ামী প্রগতিশীলদের কথা বললাম তারা তো জ্যান্ত খেমিস লেডির ভৃত্য! তাদের যে কোন আদর্শ নেই সেটা এই কয়েক বছরে প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে হেফাজতী বুদ্ধিজীবী আর অনলাইন এক্টিভিস্টরা কথায় কথায় সেক্যুলারদের মন্ডুপাত করেন কেন?
আসল গোমড়টা অন্যখানে। আমরা ভুলে যাই বাংলার বিশাল গ্রামপ্রান্তরে শাহ আবদুল করিমের সেক্যুলারিজম ছড়িয়ে আছে। মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান যখন গায় ‘মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না’ তখন মানুষকে এক ভিন্ন ভাব জগতে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন দেবতার’ এক গ্রাম্য উপলব্ধি মাওলানার রগচটা আল্লাহ থেকে অন্য এক ভক্তির জগতে টেনে নেয়। লালনের অনুসারী বাউলরা এখনো দোতরা নিয়ে মানুষকে সেই মানুষ হবার মন্ত্র শেখায়। লালন অনুসারীদের হত্যা একটা মিশন এই কারণেই। করিমের স্বপ্ন ‘এই পৃথিবীটা একদিন বাউলের হবে’ এটাই সেক্যুলারিজমের অন্তিম কথা। মানুষকে বাউল হতে হবে। বাউলের কোন ধর্ম নাই জাতি নাই। মানুষত্ব আর প্রেম-ভালবাসাই তার সত্ত্বা। হেফাজতী বুদ্ধিজীবীরা শত শত বছর ধরে বাংলার গ্রামের প্রকৃত শিক্ষিত এইসব সেক্যুলার সাধকদের ভয়েই ভীত। লালন করিমদের বিকল্প বিকল্প খুঁজছে তারা। কাশেম বিন আবু বকরকে সেই খাতে একটা এক্সিপেরিমেন্ট মাত্র