যারা বিজ্ঞান সম্পর্কে ন্যুনতম জ্ঞান রাখেন তারা জানেন যে বিবর্তন একটি প্রমাণিত সত্য। কিন্তু তারপরও প্রায় সকল ধর্মই বিবর্তনবাদের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এর পেছনের মূল কারন হলো, বিবর্তনবাদের সত্যতা স্বীকার করতে হোলে কোন ধর্মেরই আর কোন অস্তিত্ব থাকে না। ধর্মকে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্য গড়ে উঠেছে বহু বছর আগে, তা মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
বিবর্তনের মত প্রমানিত সত্যকে ধার্মিকদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও অক্সিজেন ছাড়াই বোরাকে চড়ে সপ্ত আসমান গমন অথবা মাছের পেটে বেঁচে থাকা কিংবা চাঁদকে আঙ্গুলের ইশারায় দুই ভাগ করে ফেলাকে বিশ্বাস করতে তাদের একটুও কষ্ট হয়না। এই সমস্ত নাকি ঈশ্বরের মিরাকেল। যদি ঈশ্বর তার প্রেরিত নবীদের কথা সত্যি প্রমান করতে মিরাকেল দেখাতে পারেন তবে সেই নবীদের ক্রুশবিদ্ধ অথবা ইহুদীর বিষপ্রয়োগে হত্যা হওয়ার সময় কেন মিরাকেল দেখালেন না, সেই প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যায়না। যদিও এসব মিরাকেলের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় শুধু ধর্মগ্রন্থগুলিতে যেগুলির কোন ঐতিহাসিক চাক্ষুষ প্রমান পাওয়া যায়না।
একজন ধার্মিকের সাথে বিবর্তন নিয়ে তর্ক হচ্ছিল। মানুষ কিভাবে বানর থেকে এসেছে, এই প্রশ্ন করেই সে হেসে কুটিকুটি। আমি তাকে দেখালাম, কার্বন ডেটিং, ফসিল রেকর্ডস এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রমান। সে তখন আমাকে দেখালো, এটা নাকি কুরানে অনেক আগে থেকেই বলা আছে।
”যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন, যাদের প্রতি তিনি ক্রোধাম্বিত হয়েছেন, যাদের কতককে বানর ও শুকরে রূপান্তরিত করে দিয়েছেন”—–৫:৬০
এই আয়াত দ্বারাই নাকি প্রমানিত, আমরা যেসব ফসিল দেখছি সেসব নাকি আল্লাহ্র আজাব তাই এসব ফসিল হল সেই সব অভিশপ্ত বানরদের ফসিল। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তাহলে আমরা কেন এখনো কোন প্রাচীন অভিশপ্ত শুকরের ফসিল খুজে পাইনি?
সেই ধার্মিকটি বললেন, ওনার একটু তাড়া আছে, তাই তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন।
অনেকেই বলেন, যদি আমরা বানর থেকেই বিবর্তিত তাহলে এখনো কেন বানর দেখতে পাওয়া যায়? তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমরা বানর থেকে সৃষ্ট নই। আমরা সবাই একই এনসেস্টর থেকে এসেছি। শিম্পাঞ্জী এবং আমাদের পূর্বপুরুষ একই যারা ৬ মিলিয়ন বছর আগে এই পৃথিবীতেই বসবাস করত। মানুষ, শিম্পাঞ্জী, ওরাংওটাং, বেবুন আমরা সবাই চাচাতো ভাই। আমরা সবাই বিবর্তনের মাধ্যমে আজকে এই অবস্থায় পৌঁছেছি।
আরেকটি প্রশ্ন অনেকেই করে, যদি বিবর্তন সত্যি হয়েই থাকে তবে এখন কেন বিবর্তন দেখা যায়না? তাদেরকে বলি, আপনি যদি কয়েকশো মিলিয়ন বছর বাঁচতে পারেন, আপনিও নিজের চোখে বিবর্তন দেখতে পাবেন। একটি প্রানী থেকে কাঠামোগত দিক দিয়ে পরিবর্তন হতে অনেক মিলিয়ন বছর সময় লাগে। এটা কোন ম্যাজিক নয় যে, পাঁচ বছরেই কুকুর থেকে মুরগী হয়ে যাবে। তবে কিছু পরিবর্তন আপনি নিজেও খেয়াল করতে পারেন। আগের যুগের মানুষ অনেক লম্বা এবং দীর্ঘায়ু ছিল। দিন দিন মানুষের উচ্চতা কমছে এবং মানুষের বুদ্ধি বাড়ছে। তাই চাইনিজদের বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে আধুনিক মানুষ বলা হয়ে থাকে। ২০-৩০ বছর আগেও বাচ্চারা ৪-৫ বছরের আগে ঠিকভাবে কথা বলতে পারতো না, এখন আমরা দেখতেই পাচ্ছি এই বয়সের বাচ্চারা কত স্মার্ট। বিবর্তন হচ্ছে ঠিক আমাদের চোখের সামনে কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। যেমন আপনার পরিবারের সাথে যদি আপনি সবসময় থাকেন তাদের কোন পরিবর্তন আপনি দেখতে পান না, কিন্তু কয়েক বছর পর যদি দেখা হয়, তখন খেয়াল করেন আপনার বাবা হয়ত একটু শুকিয়ে গেছেন অথবা আপনার ভাই একটু মোটা হয়ে গেছেন।
কয়েকদিন আগে বইমেলায় একটা বই বের হয়েছে ”প্যারাডক্সিকাল সাজিদ” নামে। বিবর্তনকে ডিবাঙ্ক করাই ছিল এই বইয়ের উদ্দেশ্য। ধর্মের সাথে ভুয়া নিউজপেপারের লিঙ্ক যুক্ত করে বিবর্তনের মত প্রমানিত সত্যকে মিথ্যা প্রমান করার অপচেষ্টা। যেই বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সূর্য থেকে নাকি পৃথিবীতে কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথিবীতে আসে, এবং পৃথিবীর ওজোনস্তরের কারনে নাকি কার্বন ডাই অক্সাইড নাকি পৃথিবীর বাইরে বের হতে পারেনা। এটাই নাকি গ্রীন হাউস এফেক্ট। এছাড়াও কোন পীয়ার রিভিউড জার্নালের তোয়াক্কা না করেই কিছু নিউজপেপারের কোটেশন দিয়েই নাকি বিবর্তনকে মিথ্যা প্রমান করা হয়েছে। বাংলাদেশের ধার্মিক জনগোষ্ঠী তথা মুসলমানদের কাছে নাকি এই বই হটকেকের মত বিক্রি হচ্ছে। যদি এই আরিফ আজাদ বিবর্তনের মত একটি প্রমানিত সত্যকে মিথ্যা প্রমান করতে পারে, সে কেন এখনও নোবেল পায়নি অথবা সারা বিশ্বে তাকে নিয়ে কেন আলোড়ন হয়নি অথবা তার বই কেন শুধুমাত্র নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানেই সীমাবদ্ধ, সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।
আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি,
যেখানে স্টিফেন হকিন্স, বিল নাই অথবা নীল ডিগ্রেস টাইসনের মত বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা নাস্তিক অথবা অজ্ঞেয়বাদী, যারা মহাবিশ্বের রহস্য খুজে বের করার চেষ্টা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন, আবার বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের কোন মাদ্রাসার একজন ছাত্র দাবী করে, কুরআন পড়েই নাকি মহাবিশ্বের সব রহস্য জানা সম্ভব।